ধাওয়া খেয়ে দৌড়ে পালানোর সময় শিহাবের এক পাটি জুতা কাদার ভেতর আটকে গেলো। প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে জুতার মায়া ত্যাগ করে শিহাব পালিয়ে গেলেন। এর প্রায় ঘন্টাখানেক পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে শিহাব জুতা নিতে এসে আলতার ভাইদের পাতা ফাঁদে বোকার মত ধরা পড়ে গেলেন। শিহাব দক্ষিন দিকের জানালায় এসেছিলেন আলতার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে। আলতাই খবর পাঠিয়েছিলেন। গত ছয়মাস ধরে আলতা আর শিহাবের মন দেওয়া নেওয়া চলছে।
আলতার বাবা বিচক্ষণ মানুষ। তিনি বুঝিয়ে সুঝিয়ে উত্তেজিত ছেলেদের শান্ত করলেন। তারপর শিহাব আর নিজের পরিবারের লোকজনদের নিয়ে সালিশ বসালেন। সালিশে শিহাব দুজনের ভালবাসার কথা জোর গলায় স্বীকার করলেও আলতা পুরো বিষয়টি অস্বীকার করলেন। শিহাব যে আলতাদের আশ্রিত সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে আলতা বিরক্ত ভঙ্গিতে সালিশ ছেড়ে উঠে গেলেন।
তারপর অনেক অনেক দিন পরের কথা।
বারান্দার গ্রীল ধরে নিতু দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে আরেকবার সব কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। কোন কিছু বাদ পড়লে চলবেনা। এমনকি বাসের ঘটনাটাও। নিতুর ভাবনার ঠিক মাঝামাঝি সময়ে ভেতর থেকে পুরুষালি কন্ঠে ডাক এলো, এই শুনছো?
ভীষণ রকম কুয়াশা পড়েছে আজ। গ্রীল পেরিয়ে রাঁধাচুড়ার যে ডালটা নিচের দিকে ঝুঁকে আছে সেখানেও এক খাবলা কুয়াশা জমে আছে। তিন চার হাত দূরের সবকিছু অস্পষ্ট। ঘোলাটে। নিতু সেদিকে তাকিয়ে একটু উঁচু স্বরে বললো, আসছি,এক মিনিট।
আজ ছুটির দিন। ছুটির দিনে নিতুর স্বামীর ঘুম সকাল ন'টার আগে ভাঙে না। আজ হলটা কি? নিশ্চয়ই এখন চা করে দিতে হবে। নিতু কিছুটা অনিচ্ছায় ঘরে এলো। মাথার ভেতরে গোছানো কথা গুলো সরসর করে হেটে বেড়াচ্ছে। এখন না লিখে ফেললেই নয়।
নিতুর স্বামী কম্বল বুক অবধি টেনে খাটে হেলান দিয়ে বসেছেন। খুটখাট করে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছেন। নিতু চায়ের কাপ স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার বারান্দায় এসে দাড়ালো।
চা শেষ করে নিতু ঘরে এলো। নিতুর স্বামী একমনে অফিসের কাজ করে যাচ্ছেন। এসময় সাত স্কেলে ভূমিকম্প হলেও তিনি টের পাবেন বলে মনে হয়না। সারাক্ষণ শুধু কাজ আর কাজ। অবশ্য এজন্য উন্নতিও করেছেন খুব দ্রুত।
নিতু স্বামীর হাত আলতো ছুঁয়ে অভিমানি স্বরে ডাকলো,এই শোনোনা।
নিতুর স্বামী ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, আজকেই প্রপোজাল সাবমিটের লাষ্ট ডেট,কাজ শেষ না করতে পারলে আমি শেষ।
বলে পুনরায় লগ ফ্রেমের কাজে মন দিলেন।
নিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিল থেকে ডায়েরি আর কলমটা নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।
নিতুর শ্বশুর শাশুড়ি গিয়েছেন মেয়ের বাসায়। একে আজ ছুটির দিন,তারউপর বাসায় নিতুরা দুজন মাত্র মানুষ। নাশতা বাইরে থেকেও আনিয়ে নেয়া যাবে। অনেকটা সময় আছে হাতে।
সোফায় পা উঠিয়ে নিতু আরাম করে বসে একটু একটু করে লেখা শুরু করলো। নিতুর ভালবাসার কথা। সেই একটা বছরে ঘটে যাওয়া সুসময় আর দুঃসময়ের কথা।
লিখতে লিখতে কয়েকটা জায়গায় এসে নিতুর কাঁপুনি এসে গেলো। ও কলম থামিয়ে গায়ের পশমিনা শালটা ভালভাবে জড়িয়ে নিয়ে লেখায় মন দিলো। অদ্ভুত রকম শীত লাগছে। সেই উত্তাল সময়ের ঢেউ যেন আবার এসে আছড়ে পড়ছে নিতুর গায়ে। নিতুর চোখে কি পানি এসেছে? নিতু কি কাঁদছে?
ফেইসবুকে জুনায়েদের সাথে নিতুর পরিচয়টা বেশ কাকতালীয় ভাবে হয়েছিলো। নিতু তখন সেকেন্ড সেমিস্টারে পড়ছে। আর জুনায়েদ মাষ্টার্সে।
জুনায়েদ বরাবরই অমিশুক আর গম্ভীর প্রকৃতির ছেলে। সেকারনে হলের রুমমেটরাও জুনায়েদকে কখনো ঘাঁটাতো না। জুনায়েদের রুমমেটরা যখন রাত জেগে ফেসবুকে পড়ে থাকতো তখন জুনায়েদ গভীর মনযোগে বইয়ের পাতায় ডুবে থাকতো।
এভাবেই চলছিলো জুনায়েদের জীবন। এরইমধ্যে একদিন ভার্সিটিতে গরমের ছুটি হলো। অন্যান্য রুমমেটদের মত জুনায়েদও ছুটি কাটাতে নিজ গ্রামে বাবা মায়ের কাছে গেলো।
গ্রামে দিনের বেলা জুনায়েদের সময় ভাল কাটলেও সন্ধার পরে সময় যেন আর কাটতে চাইতো না। তখন নিরুপায় হয়ে বিভিন্নধরনের বই পড়তো জুনায়েদ। একদিন একটা গল্পের বই নিয়ে পড়তে গিয়ে জুনায়েদ চমকে গেলো। বইয়ের একটা পৃষ্ঠায় কম করে হলেও অন্তত পনেরো বার লেখা জুনায়েদ প্লাস নিতু।
প্রথমে বুঝতে না পারলেও হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত জুনায়েদের মনে পড়লো নিতুর কথা।
হ্যা নিতুই তো নাম ছিলো মেয়েটির। এই গ্রামেরই মেয়ে। জুনায়েদ যখন ক্যাডেট কলেজ থেকে বছরে চারবার ছুটি কাটাতে বাড়ি আসতো তখন জুনায়েদের সমবয়সী ঐ মেয়েটি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো জুনায়েদের দিকে।
তারপর তো একদিন সাহস করে নিতু নামের মেয়েটি তিন পৃষ্ঠার ভুল বানানে ভর্তি একটা চিঠিই লিখে বসলো,আর চিঠির সাথে উপহার হিসেবে এই গল্পের বই।
এতদিন পরে জুনায়েদের চোখের সামনে যেন একে একে সব পর্দায় ফুটে উঠলো। হঠাৎ মনে হলো, নিতু মেয়েটা এখন কোথায় আছে? ও কি এখনো আমাকে মনে রেখেছে?
আজকাল কারো পরিচয় খুঁজতে হলে সবাই প্রথমে যে কাজটি করে জুনায়েদও তাই করলো। প্রথমে নিজের নামে একটা একাউন্ট খুলে ফেসবুকে নিতু লিখে সার্চ দিলো। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে অসংখ্য নিতু জুনায়েদের চোখের সামনে হাযির হলো। এত এত নিতুর ভীড়ে জুনায়েদ আসল নিতুকে আর খুঁজে পেলোনা।
তাই হঠাৎ একটা দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেলো জুনায়েদের মনে।
প্রোফাইল দেখে বেছে বেছে নিজের পছন্দমাফিক অন্তত ডজন খানেক নিতুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো।
এর দুদিন পরে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে জুনায়েদ অবাক হয়ে গেলো। এতগুলো নিতুর মধ্য থেকে মাত্র একজন নিতু রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেছে এবং সাথে একটা মেসেজও দিয়েছে। 'আচ্ছা আপনি এত বড় মানুষ কেন?'
চেনা নেই জানা নেই অথচ পরিচিত মানুষের মত প্রশ্ন করছে কেন মেয়েটা? এই কি তাহলে সেই নিতু?
কৌতুহলের কাছে হার মেনে একসময় জুনায়েদ পাল্টা জবাব দিলো, ' তাই? কেউ বলেনি তো! '
সাথে সাথে জবাব এলো, বলতে হবে কেন? আপনি নিজে জানেন না?
মেসেজ লেখার এক ফাঁকে জুনায়েদ নিতুর প্রোফাইল তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলো। কোথাও নিতুর কোন ছবি কিংবা চেনা যায় এমন কিছু খুঁজে পেল না। শুধু জানতে পারলো এই নিতু ঢাকার মিরপুরে থাকে। ব্যস এতটুকুই।
এই শুরু।
এভাবে তিনদিন ধরে মেসেজ আসা যাওয়া চলতে থাকে ঠিকই কিন্তু কখনো কথা হয়না। মাত্র বাহাত্তর ঘন্টা কাটতে না কাটতেই জুনায়েদ নিজের ভেতরে একটা অচেনা হাওয়া টের পায়। ঐ মেয়েটিকে সামনা সামনি দেখার জন্য প্রচন্ড অস্থিরতায় একা একা ছটফট করে। মেয়েটি মেসেজের উত্তর দিতে দেরী করলে গলা শুকিয়ে আসে।
সবসময় মনের ভেতর একটা ভয় কাজ করতে থাকে জুনায়েদের। নিতু সত্যি মেয়ে তো? কোন ফেইক আইডি নয়তো?
নিতুকে নিয়ে জুনায়েদের মনে অনিশ্চয়তা যখন চরমে উঠলো তখন এতদিনের সংষ্কার ভুলে নিতুর কাছে ওর ফোন নম্বর চাইলো।
নিতু দুই একদিন গাইগুই করে অবশেষে দিলো কিন্তু সাথে শর্ত জুড়লো,
--কখনোই কিন্তু ফোন করা যাবেনা। মনে থাকবে?
--না।
-- মানে কি?
মেসেজের উত্তর না দিয়ে জুনায়েদ নিতুকে ফোন করলো। কিন্তু কয়েকবার রিং বেজে গেলেও ওপাশে কেউ ফোন ধরলো না। অগত্যা জুনায়েদ আবার ফেসবুকে ঢুকলো।
জুনায়েদ কিছু লেখার আগে মেসেজ আসলো
-- আপনি তো আচ্ছা রকম নির্লজ্জ!
--আমি আবার কি করলাম?
-- ভেবেছেন আমি ধরতে পারবোনা তাইনা? এইমাত্র তো আপনিই ফোন করেছিলেন।
-- তোমার তো অনেক বুদ্ধি!
-- একশ বার ফোন করলেও আমি ফোন ধরবোনা। কখনোই না।
এ কথা শুনে জুনায়েদের বুকের মধ্যে অনিশ্চয়তা আবার ঘুরে ঘুরে পাক খেতে থাকে। জুনায়েদ কাঁপা হাতে টাইপ করে,
--তারমানে তুমি একটা ছেলে। ঠিক?
--মোটেও না।
-- মোটেও হ্যা।
--সত্যি কিন্তু আমি মেয়ে।
-- মিথ্যে কেন বলছো? মিথ্যা বলা মহা পাপ।
-- মিথ্যা না। সত্যি।
-- তাহলে প্রমান দাও।
-- প্রমান? কিভাবে?
--আমার ফোন ধরে।
-- আচ্ছা ঠিক আছে। আমি শুধু হ্যালো বলেই কেটে দেব । চলবে?
-- দৌড়াবে।
সে রাতে জুনায়েদের আর ঘুম এলো না। বুকের ভেতর সুখের ব্যাথা নিয়ে সারারাত বিছানায় ছটফট করে কাটালো।
ছুটি শেষ হতে এখনো অনেক দিন দেরী। কিন্তু সকাল হলেই জুনায়েদকে ঢাকা যেতে হবে। নিতুকে সামনাসামনি দেখতে না পেলে মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবে।
সেদিনই বাবা মাকে ভুলভাল বুঝিয়ে জুনায়েদ ঢাকায় ভাই ভাবির বাসায় চলে এলো। এসেই নিতুর কাছে আবদার করলো দেখা করার। নিতু কোনভাবেই রাজি হলোনা। তখন জুনায়েদকে কৌশলের আশ্রয় নিতে হলো। জুনায়েদ কথায় কথায় নিতুর কাছ থেকে ওর বাসার ঠিকানা জেনে নিলো।
ঠিকানা পাওয়ার সাথেসাথেই ঐ কাকভোরে জুনায়েদ চলে গেলো নিতুদের এলাকায়।
বাসা খুঁজে পেতেও সময় লাগলো না। নিতুদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে জুনায়েদ মেসেজ দিলো,
--আমি তোমার বাসার সামনে। কলিংবেলের সুইচে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছি। তুমি যদি আমার সাথে দেখা করতে রাজি না হও তাহলে বাসায় এসে দেখা করবো।
মেসেজ সেন্ড হওয়ার সাথেসাথে নিতুর ফোন এলো। ভয়ার্ত স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বললো,প্লীজ পাগলামি করবেননা। বাবা বাসায়। একদম মেরে ফেলবে।
-- তাহলে কথা দাও আজ দেখা করবে।
-- ঠিক আছে কিন্তু প্লিজ আপনি ওখান থেকে চলে যান।
-- ঠিক তো?
--ঠিক।
এভাবে মাস চারেক ধরে চলছিলো জুনায়েদ আর নিতুর একসাথে পথ চলা।
ঢাকার চেনা অচেনা গলিতে দুজন হাতে হাত রেখে হাটতে হাটতে চলে যেত বহুদূর। কখনো খুব ভোরে উঠে সরাসরি কমলাপুর রেলস্টেশন। ধারেকাছের কোন স্টেশনের টিকিট কেটে দুজনে চলন্ত ট্রেনের দরজায় দাড়িয়ে চলে যেত সেই অচেনা স্টেশনে। আবার কখনো তড়িঘড়ি করে নারায়ণগঞ্জ আর তারপর মেঘনার ধু ধু বালুচরে পাশাপাশি বসে থাকা। আবোলতাবোল সব কথায় ভরে উঠতো নদীর পাড়।
এর মধ্যে জুনায়েদের মাস্টার্স পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেলো। আর নিতুর তখন পরীক্ষা সামনে। ঠিক এসময়ে নিতুর জীবনে প্রথম ঝড়ের ঝাপটা এসে লাগলো।
নিতুর বাবা সব জেনে যাওয়ায় নিতু আর জুনায়েদের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো।
নিতুর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে জুনায়েদ বুঝতে পারছিলো না ওর কি করা উচিত।
কয়েকবার নিতুদের বাসার সামনে অস্থির ভাবে আসা যাওয়া করলো কিন্তু বারান্দায় নিতুকে দেখা গেলোনা। এভাবে প্রায় তিন চারদিন উষ্কখুষ্ক চুল নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত নিতুদের বাসার সামনে এসে দাড়িয়ে রইলো কিন্তু কোন লাভ হলোনা।
নিতুর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে জুনায়েদের হঠাৎ হঠাৎ মনে হতো চলন্ত ট্রেনের সামনে গিয়ে একবার শুয়ে পড়লে কেমন হয়? অথবা ফ্যানের সাথে দড়ি বেধে ঝুলে পড়লে?
নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে ওঠে জুনায়েদ। শেষমেশ কি ও পাগল হয়ে যাচ্ছে?
জুনায়েদের বড় ভাই জুনায়েদের মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করেছেন। ভাবলেন নিশ্চয়ই বন্ধুদের সাথে কোন ঝামেলায় জড়িয়েছে। মেয়ে ঘটিত কোন ব্যাপার যে হতে পারে তা তিনি কল্পনাই করতে পারলেন না।
জুনায়েদকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন। সব শুনে জুনায়েদের ভাই কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন।
তারপর জুনায়েদকে বোঝালেন। নিতু সত্যিই জুনায়েদকে ভালবাসে কিনা তা না জেনে কিছু করা ঠিক হবেনা। তাছাড়া এমন প্রেম জীবনে অনেকবার আসে। বিয়ের আগে তার নিজের জীবনেও কয়েকজন এসেছিলো। এগুলো জীবনেরই অংশ।
কিন্তু জুনায়েদ নাছোড়বান্দা। যা করার এখুনি করতে হবে। নিতুর বাবার পক্ষে নিতুকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়াও অসম্ভব কিছু নয়।
জুনায়েদের ভাই নিজের স্ত্রীকে ডেকে বললেন, জুনায়েদ কে এখন কিছু বোঝাতে যেওনা। প্রথম প্রেম তো! আপাতত নিজের মত থাকুক। কিছু দিন গেলে আপনাআপনি ভুত নেমে যাবে।
জুনায়েদের রাতে ভালো ঘুম হয়না,সারা রাত আধো ঘুম আধো জাগরনে মুঠোফোন হাতে নিয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে।
একদিন রাত প্রায় তিনটার দিকে একটা অচেনা নম্বর থেকে মেসেজ আসে। ' বাবা আমাদের গ্রামে পাঠিয়ে দেবে,প্লীজ কিছু করো। আমি বাসায় বলেছি আমাদের বিয়ে হয়েছে।'
এই মেসেজ পেয়ে জুনায়েদ গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। নিতুর ব্যাপারে জুনায়েদের কখনোই সংশয় ছিলোনা। এখন আরো নিঃসন্দেহ হলো। জুনায়েদ কতটুকু কি করতে পারবে নিতু জানেনা অথচ কত অবলীলায় জুনায়েদকে বিশ্বাস করে বিয়ের ব্যাপারটা বানিয়ে বলে দিলো। এমন মেয়েকে ভাল না বেসে পারা যায়?
জুনায়েদ সেইমুহূর্তে ফেসবুক থেকে নিতুর এক বান্ধবী মুনাকে খুঁজে বের করলো।
মুনাকে বললো নিতুর সাথে যোগাযোগ করতে। নিতুর মায়ের ফোন বন্ধ তাই মুনা বাধ্য হয়ে নিতুর বাবাকে ফোন করলো। নিতুর বাবা ফোন ধরলে মুনা শেখানো কথা গুলো বললো।
--আঙ্কেল আমি নিতুর বান্ধবী,ওর ফোন বন্ধ কেন?
--সে কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে?
--না মানে ওর কাছে আমার কিছু নোট ছিলো,তাহলে কি আমি বাসায় আসবো?
-- নোটের ছুতো দিয়ে কে তোমাকে ফোন করিয়েছে সেটা ভালভাবে বুঝতে পারছি। ঐ জানোয়ারটাকে বলে দিও আর এক পা এগোলে ওকে আমি পুলিশে দেব।
নিতুর বাবা ফোন কেটে দিলেন।
জুনায়েদ বুঝলো এভাবে হবেনা। নিতুদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হবে। নিতু যেহেতু বলেছে ওদের বিয়ে হয়েছে তারমানে নিতুর বাবা যা করবেন ভেবেচিন্তে করবেন।
জুনায়েদ এই প্রথম আশার আলো দেখতে পেলো।
নিতুদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হলে সবার আগে একটা চাকুরির ব্যাবস্থা না করলেই নয়।
এক সপ্তাহের মধ্যে চাকরি যোগাড় করা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে ও মান সম্মান বিসর্জন দিয়ে ক্যাডেট কলেজের পরিচিত কয়েকজন বড় ভাইকে ফোন করলো। যদি তারা কোন ব্যাবস্থা করে দিতে পারেন।
জুনায়েদের ভাগ্যটা ভালই বলতে হবে কারন একজন জুনায়েদকে মোটামুটি গোছের একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন।
সুখবর পেয়েই জুনায়েদ নিতুর বাবাকে ফোন করলো। এত খারাপ ভাষায় কোন ভদ্রলোক কথা বলতে পারেন জুনায়েদের জানা ছিলোনা। ও দাঁতে দাঁত চেপে সব হজম করলো। কারন এখন সময় ওর বিপক্ষে।
জুনায়েদ ফোন করা বন্ধ করলো না। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও বন্ধ হলোনা।
একদিন হঠাৎ করে নিতুর বাবা নিজে থেকে জুনায়েদকে ফোন করলেন। জুনায়েদের সাথে দেখা করতে চান।
জুনায়েদ ধরে নিয়েছিলো ভদ্রলোক বোধহয় মেয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। আনন্দে জুনায়েদের চোখে পানি এসে গেলো। ও সেই মুহূর্তে জরুরী গলায় বাবা মাকে ফোন করে ভাইয়ের বাসায় আসতে বললো।
নিতুর বাবা শিহাব উদ্দিন প্রচন্ড মেজাজ খারাপ নিয়ে রেষ্টুরেন্টে বসে আছেন। সারা জীবন তিনি অন্যের ছেলে মেয়েদের ভালবাসায় যথাসাধ্য বাধা দিয়ে এসেছেন অথচ আজ কিনা তারই মেয়ে এই পথে হাটছে। যতই এসব ভাবছেন ততই রাগে তার রক্তে আগুন জ্বলছে। মেয়েটাকে আজ হাতের সুখ মিটিয়ে মেরেছেন। এরপরও যদি ভুত না নামে তাহলে আরেক ডোজ দিতে হবে।
মারের চেয়ে বড় ঔষধ পৃথিবীতে নাই।
তার সাথে যে অন্যায় হয়েছিলো তা তিনি ভোলেন নি। এর শোধ তিনি আজীবন নিয়ে যাবেন। কি দোষ ছিলো তার? তিনি যতদিন বাঁচবেন ততদিন তার আশেপাশের প্রতিটি ভালবাসার গল্প কালো হাত দিয়ে তছনছ করে দেবেন।
জুনায়েদ ঠিক সময়ে রেষ্টুরেন্টে হাজির হলো। জুনায়েদকে দেখে নিতুর বাবার হাত নিশপিশ করে উঠলো। ইচ্ছে করছে মেরে এখানেই লাশ বানিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি বহুকষ্টে নিজেকে সামলালেন। পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করা মানে হাটে হাড়ি ভেঙে দেওয়া। যা করার ভেবেচিন্তে করতে হবে। শুধু ছেলেকে না,দরকার হলে ছেলের চৌদ্দ গোষ্ঠীকে তিনি ঘোল খাইয়ে ছাড়বেন।
নিতুর বাবা জুনায়েদকে জহুরির চোখে মেপে নিয়ে গলায় মধু ঢেলে বললেন,
--তোমাকে দেখে তো ভদ্রঘরের ছেলে বলেই মনে হয়,তা এ কাজ করতে গেলে কেন?
এ কথার কি জবাব দেয়া যায় জুনায়েদ ভেবে পেল না। ও মাথা নিচু করে রইলো।
নিতুর বাবাই আবার কথা বললেন,
--নিতুর ব্যাপারে তুমি কতটুকু জানো?
--যতটুকু জানার জেনেছি।
-- বুঝতে পারছি কিছুই জানোনা। আমার মেয়েটা অসম্ভব বদমেজাজী। ওর স্বভাব চরিত্রও ভালো না। এর আগেও নিতু বহুবার এই কান্ড ঘটিয়েছে। দেখো বাবা তুমি একটা ভদ্র এবং শিক্ষিত ছেলে। এইসব মাথা থেকে ঝেড়েফেলে নিজের দিকে মন দাও।
এই বলে তিনি আচমকা উঠে হনহন করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন।
জুনায়েদ নিতুর বাবার গমন পথের দিকে তাকিয়ে স্থানুর মত বসে রইলো। ভদ্রলোকের মাথায় ছিট আছে নাকি?
বিকেলের দিকে নিতুর শ্বশুর শাশুড়ি মেয়ের বাসা থেকে ফিরলেন। আবার শুরু হলো নিতুর ব্যস্ততা। লেখাটা শেষ করতে হবে। বিয়ের পর থেকে নিতু অনেকদিন ভেবেছে নিজের প্রথম ভালবাসার কথা গল্প আকারে লিখে রাখবে যাতে স্মৃতির পাতায় ধুলো জমলেও ভালবাসার স্মৃতিগুলো অমলিন থাকে।
এক সপ্তাহ পরে নিতু আবার ডায়েরির পাতা খুলে বসেছে। ডায়েরি পড়তে গিয়ে নিতুর খুব বাবার কথা মনে পড়ছে। নিতুদের বিয়ের পরে নিতুর বাবা যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে গেলেন।
নিতুর স্বামী ছুটির দিনে আরাম করে ঘুমুচ্ছেন। নিতু একবার সেদিকে তাকিয়ে ডায়েরি বন্ধ করে বিছানায় এসে স্বামীর কপালে হাত রেখে বললো,
--এই, ঘুমুচ্ছো?
নিতুর স্বামী চোখ না খুলেই 'হু' বলে নিতুকে এক হাতে জড়িয়ে কাছে টানলেন। নিতু কাঁপা গলায় বললো,
--আমার খুব মন খারাপ লাগছে।
-- কেন? কেউ কিছু বলেছে?
--না।
-- তাহলে?
-- জানিনা।
নিতুর স্বামী নিতুকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
--তোমার লেখালেখি কেমন চলছে?
নিতু ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো।
--তারমানে? তুমি লুকিয়ে আমার লেখা পড়েছো?
--আরে না।
-- তাহলে তুমি জানলে কি করে আমি কিছু লিখছি?
নিতুর স্বামী নিতুর এক হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন,
--যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি সেদিনই একটা ভালবাসার শেকল তোমার পায়ে আটকে দিয়েছি। শেকলটা ঝুনঝুন করে আমাকে তোমার কাজকর্মের হদিশ দেয়। শিকলটা গত সপ্তাহে আমাকে বলেছে তুমি একটা ভালবাসার গল্প লিখছো। সাথে অবশ্য এটাও বলেছে যে,প্রথম যেদিন আমি তোমাদের বাসার সামনে যাই সেদিন উপর থেকে কেউ একজন ব্রাশ করে আমার মাথায় থুথু ফেলেছিলো সেটা তুমি লেখ নি। এমনকি আজিমপুর থেকে ফেরার সময় বাসে বসে কি একটা নিয়ে তোমাকে বকা দিয়েছিলাম আর তুমি সেই আজিমপুর থেকে কাঁদতে কাঁদতে আন্সারক্যাম্প পর্যন্ত এসেছিলে সেটাও লেখ নি।
কথা শুনে রাগে দুঃখে নিতু চেঁচিয়ে উঠলো,
--তারমানে তুমি সব পড়েছো! মিথ্যুক!
নিতুর স্বামী নিতুকে আরো কাছে টেনে নিয়ে গাঢ় স্বরে বললেন, সেইসব দিনের কথে ভাবলে তোমার মত আমারও প্রচন্ড কষ্ট হয়। কিন্তু আমি ভাগ্যবান। আমি শেষপর্যন্ত নিতু নামের এই মেয়েটিকে পেয়েছি।
নিতুর চোখে দুষ্টুমি ঝিলিক দিয়ে ওঠে, না পেলে কি হত?
--কি হত? দাড়াও দেখাচ্ছি।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
গল্পটি স্রেফ একটি ভালবাসার গল্পই হয়েছে।
০৩ আগষ্ট - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
১৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪